Search This Blog

Saturday, May 5, 2018

গ্রন্থাগারের কার্যাবলী। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় গ্রন্থাগারের ভূমিকা।

**গ্রন্থাগারের কার্যাবলী:
আধুনিক গ্রন্থাগারগুলো প্রথাগত ধারণার বাইরে এসে পঠিকের জন্য নতুন নতুন সেবা প্রবর্তন করেছে। এর মধ্যে আছে মুদ্রিত ও ইলেকট্রনিক তথ্যসেবা, অনুবাদ, সারসংক্ষেপণ ও নির্ঘণ্টীকরণ, আন্ত:গ্রন্থাগার লেনদেন, ডকুমেন্ট ডেলেভারি ইত্যাদি সেবা। এসব সেবা আধুনিক গ্রন্থাগারকে একটি উৎকর্ষ কেন্দ্রে পরিনত করেছে। একটি গ্রন্থাগারের কার্যাবলিগুলো নি¤েœ আলোচনা করা হলো-
১। সংগঠন ও প্রশাসন: সংগঠন ও প্রশাসন দুটি পরস্পর সম্পর্কিত কর্মকান্ড। সংগঠনের কাজ হচ্ছে সাংগঠনিক কর্ম-কাঠামোর নকশা প্রণয়ন, বিভিন্ন অপারেটিং ইউনিট- যেমনবিভাগ, উপবিভাগ, শাখা ইত্যাদিতে কর্ম এলাকাগুলোকে ভাগ করা। আর প্রশাসনের কাজ হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ন ও অন্যান্য নিয়ন্ত্রণমূলক কর্মকান্ডের জন্য কর্তৃত্বায়নের রূপরেখা প্রণয়ন করা।

২। গ্রন্থাগার সংগ্রহ গড়ে তোলা: গ্রন্থাগারিক প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত বিভিন্ন নীতিপদ্ধতি এবং গ্রন্থাগারের উদ্দেশ্যের সাথে মিল তথ্য সামগ্রী সংগ্রহ করবেন। গ্রন্থাগার সংগ্রহ গড়ে তোলা কোন সাধারণ কাজ নয়। এ কাজে বিভিন্ন তথ্য উৎস, গ্রন্থাগার সামগ্রীর ধরণ এবং উপযোগীতা সম্বন্ধে ব্যাপক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

৩। গ্রন্থাগার সংগ্রহকে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা:  গ্রন্থাগারিককে তাঁর সংগ্রহীত তথ্য সামগ্রী এমনভাবে বিন্যাস্ত করতে হবে যাতে করে এসব এসব সামগ্রীর উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ এবং সেই সঙ্গে এসব সামগ্রী ব্যবহারে ব্যবহারকারীর সুবিধাও নিশ্চিত হয়। কার্যকরভাবে তথ্য সমাগ্রী সংগঠনের জন্য সবচেয়ে বড় ভিত্তি হিসেবে কাজ করে একটি শক্তিশালী শ্রেণীকরণ পদ্ধতি।যার মাধ্যমে এই সামগ্রীসমূহ সহজেই ব্যবহারের উপযোগী হয়।

৪। ব্যবহারকারীকে সেবা প্রদান করা: গ্রন্থাগার সামগ্রীর নির্বাচন, সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ এবং সংগ্রহসহ যাবতীয় কর্মকান্ডের উদ্দেশ্য একটাই- ব্যবহারকারীদেরকে সবচেয়ে ভালোভাবে তথ্যসেবা প্রদান করা। গ্রন্থাগারের সার্কুলেশন এবং রেফারেন্স এ দুটো বিভাগ হচ্ছে সেই স্থান যেখানে পাঠক এবং তথ্যসামগ্রীর যোগসূত্র ঘটে।

৫। আর্থিক বিষয়াদি সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণ: নিরবচ্ছিন্ন আর্থিক সহায়তা ছাড়া গ্রন্থাগার ও তথ্য প্রতিষ্ঠানের দৈনন্দিন কর্মকান্ড সম্পন্ন করা অসম্ভব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, একটি গ্রন্থাগারের আয়ের উৎস তেমন বেশি নয়। এগুলোর মধ্যে আছে: ঊর্ধ্বতন প্রতিষ্ঠান বা সরকার থেকে প্রাপ্ত অর্থ, অনুদান, উপহার, ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে আদায়কৃত চাঁদা, জরিমানা ইত্যাদি। গ্রন্থাগারের যথাযথ পরিচালনার জন্য একটি বার্ষিক বাজেট প্রণয়ন করা জরুরী যেটি প্রস্তুত হবে বিগত বছরের আয়-ব্যয়ের এবং গ্রন্থাগারের কর্ম-পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে। একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের অন্যতম প্রধান খাত হচ্ছে তথ্য সামগ্রী সংগ্রহ, কর্মীদের বেতন, বিভিন্ন সেবা প্রদানের খরচ, বিভিন্ন উপকরণ, আসবাব ইত্যাদি ক্রয় এবং জরুরী খাতে খরচ।

৬। সচেতনতা বিস্তার: বর্তমান প্রেক্ষাপটে গ্রন্থাগার ও তথ্য প্রতিষ্ঠানগুলো প্রথাগত সেবার পাশাপাশি নানা অপ্রথাগত কর্মকান্ড পরিচালনা করে। এসব কাজের অনেকগুলোই পরিচালিত হয় গ্রন্থাগারের সামাজিক দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধ থেকে। এর মধ্যে আছে, পাঠকেরা যাতে বহিস্থ বিভিন্ন তথ্য উৎসে প্রবেশ ও ব্যবহার করতে পারে সেজন্য একটি গেটওয়ে বা পোর্টাল হিসেবে কাজ করে, পাঠচক্র, সেমিনার, কর্মশালা ইত্যাদি আয়োজন, বয়স্ক শিক্ষা ও দূরশিক্ষণ, প্রকাশনা, গবেষণা, আর্থসামাজিক নানা বিষয়ে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন ইত্যাদি।

**আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় গ্রন্থাগারের ভূমিকা:
আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় গ্রন্থাগারের অনেক ভূমিকা রয়েছে। নি¤েœ সেগুলোর আলোচনা করা হলো-

**আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় গ্রন্থাগারের ভূমিকা:
১। শিক্ষাদান: একাডেমিক গ্রন্থাগার শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী ও গবেষকদের শিক্ষার্জনে সরাসরি ভূমিকা রাখে। বিশেষত শিক্ষার্থীরা গ্রন্থাগারের সংগ্রহ ও সেবা থেকে সরাসরি উপকৃত হন। শিক্ষকরা যেমন শিক্ষাদানের প্রয়োজনে সরাসরি গ্রন্থাগারে রক্ষিত তথ্যসামগ্রী ব্যবহার করেন তেমনি শিক্ষার্থীরাও তথ্যসামগ্রী পাঠ ও ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষালাভের জন্য নিজেদের প্রস্বতুত করেন। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাই গ্রন্থাগার ছাড়া কল্পনা করা যায় না।

২। তথ্যপ্রদান: জ্ঞানের নানা শাখার তথ্য গ্রন্থাগারে রক্ষিত থাকে। তথ্য অনুসন্ধানী মানুষ গ্রন্থাগার থেকে সরাসরি তাদের নানাবিধ তথ্য চাহিদা পূরণ করে। আধুনিক গ্রন্থাগারগুলো নানা ধরণের মুদ্রিত ও ইলেকট্রনিক তথ্য উৎসে প্রবেশের জন্য নানা প্রক্রিয়া অবলম্বন করেন। প্রকাশক বা পেশাদার তথ্য সরবরাহকারীদের ডাটাবেস থেকে সংগ্রহ করে সেটি তথ্যানুসন্ধানীদের মধ্যে বিতরণের জন্য গ্রন্থাগার আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি উপকরণ ব্যবহার করে থাকন।

৩। প্রশিক্ষণ: আধুনিক গ্রন্থাগার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সানবসম্পদ উন্নয়নের তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখে। গ্রন্থাগার হচ্ছে স্বশিক্ষিত মানেিষর আশ্রয় স্থল। অনেক জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি গ্রন্থাগার থেকেই আত্ম উন্নয়নের দীক্ষা নিয়েছেন। আধুনিক গ্রন্থাগার বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে যাতে পাঠক তাঁদের জ্ঞান চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নিজেদের সামর্থ্যও বৃদ্ধি করতে পারেন।

৪। গবেষণা: আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় গবেষকদের নানামুখী চাহিদা পূরনের মাধ্যমে গ্রন্থাগারগুলোর জ্ঞানের অগ্রগতিতে অবদান রাখে। গ্রন্থাগারের সাহায্য ও দিক নির্দেশনা ব্যতীত গবেষকদের গবেষণার কাজ দারুনভাবে ব্যহত হয়। গ্রন্থাগারে রক্ষিত জ্ঞান ভান্ডার যেমন গবেষণা কাজে অবদান রাখে তেমনি গবেষকদের দিক নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে গ্রন্থাগারিকরা গবেষণা অংশীদার ও পরামর্শক হিসেবে তাঁদের ভূমিকা পালন করেন।

৫। প্রকাশনা: গ্রন্থাগারগুলো সরাসরি পুস্তক নির্বাচক হিসেবে ভূমিকা পালন না করলেও প্রকাশনা কাজে গ্রন্থাগারের প্রচুর অবদান রাখার সুযোগ আছে। বিশেষায়িত তথ্যসামগ্রী, যেমন- নির্ঘণ্ট, সংক্ষিপ্তসার, গবেষণা মনোগ্রাফ ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে গ্রন্থাগারগুলো আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অপরিহার্য সহযোগীর ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও পাঠ্যবই, গবেষণা গ্রন্থ ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে কাজ করতে পারে গ্রন্থাগার।

**অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় গ্রন্থাগারের ভূমিকা:
১। দূরশিক্ষণ: বর্তমানে গ্রন্থাগারগুলো দূর শিক্ষণের অন্যতম প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে। গ্রন্থাগারগুলো নিজস্ব কর্মকান্ডের পাশাপাশি দূরশিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান, পাঠক্রম প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা মূল্যায়ন ইত্যাদি কাজ করে চলছে। উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও গ্রন্থাগারগুলো দূরশিক্ষণে ভূমিকা রাখছে।

২। কারিগরি শিক্ষা: অনেক গ্রন্থাগারে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এর ফলে গ্রন্থাগার গুলো যেমন সরাসরি মানব উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে, তেমনি জাতীয় উন্নয়নেও অবদান রাখার প্রয়াস পাচ্ছে।

৩। বয়স্ক শিক্ষা: গ্রন্থাগারে নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি বিশেষভাবে রাত্রিকালীন সময়ে বয়স্কশিক্ষার কার্যক্রম গ্রহন করা হচ্ছে। ফলে বয়স্ক ব্যক্তিরা শিক্ষালাভ করার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নেও অবদান রাখতে পারছেন।

৪। শিক্ষা সহায়তা: গ্রন্থাগারগুলো তাদের তথ্যভান্ডার ও শিক্ষা অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে নানা রকম শিক্ষা সহায়তা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে আছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য আছে প্রশিক্ষণ, শিক্ষা সহায়তা প্রকাশনা কার্যক্রম গ্রহণ, স্কুল ভিজিট, শিক্ষাসহায়তা উপকরণ প্রস্তুতকরণ ইত্যাদি।

৫। সচেতনতা বিস্তার: গ্রন্থাগারগুলো সেমিনার, কর্মশালা, পাঠ্যচক্র ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে শিক্ষা সংক্রান্ত সচেতনতা বিস্তার করে থাকে। এর ফলে তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়।

৬। পরামর্শ সেবা: গ্রন্থাগারগুলো অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় পরামর্শদানের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের মান দিন দিন বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলছে। সেসব প্রতিষ্ঠান অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করতে চায় তারা তথ্যসামগ্রী সংগ্রহ ও সংগঠন, তথ্যসেবা, তথ্য অনুসন্ধান ও পুনরুদ্ধার, তথ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কাজে গ্রন্থাগারের কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করে থাকে।

                                      পরিশেষে বলা যায় যে, গ্রন্থাগার একটি দেশের ঐতিহ্য বহন করে। দেশের ইতিহাস, শিক্ষাব্যবস্থা সহ আরো অনেক আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় ভূমিকা রাখে। তাছাড়া গ্রন্থাগার হচ্ছে একটি জীবন্ত উপকরণ। গ্রন্থাগারের মাধ্যমে অতীতের তথ্য সংগ্রহ করে রাখা হয় বর্তমান প্রজন্মকে সেবাদানের ক্ষেত্রে এবং গ্রন্থাগার অতীত ও বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে তথ্যের সেতুবন্ধন গড়ে তোলতে সাহায্য করে। এবং গ্রন্থাগার বর্তমানের তথ্য সামগ্রী সংগ্রহ করে রাখে যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম এখান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। এবং তাদের মধ্যে সেবুবন্ধন গড়ে ওঠে।

4 comments: